প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বনাম কর্মমুখী শিক্ষা – এখনই সময় পরিবর্তনের

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বনাম কর্মমুখী শিক্ষা – এখনই সময় পরিবর্তনের

আমাদের সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রচলিত ধারনা আছে যে কোন ছেলে বা মেয়ে যদি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করে বা একটি ভাল সাবজেক্টে চান্স পেয়ে ভাল CGPA নিয়ে Graduation শেষ করে তবে তারাই জীবনে অনেক উন্নতি করবে, ভাল চাকরি করবে, জীবনে অনেক সফল হবে। আর যাদের পড়াশোনার মন নেই, শুধু বাহিরের দুনিয়া নিয়ে আগ্রহ, রেজাল্ট খারাপ, তাদের দিয়ে জীবনে কিছুই হবে না। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। জীবনে উন্নতি, ভাল চাকরি, সফলতা লাভ এই সব কিছু কখনো ভাল রেজাল্টের উপর নির্ভর করে না, করে দুটি বৈশিষ্ট্যের উপর, Creativity ও Innovation। এই দুটি বৈশিষ্ট্য সাধারণত ছোটবেলা থেকেই একটি শিশুর মধ্যে বেড়ে ওঠে। আমরা জানি যে ছোটবেলায় একটি শিশুর মন থাকে ঠিক কাদামাটির মত। তাকে ঠিক যেভাবে গড়া হয় তখন সে ঠিক সেভাবেই বড় হয়ে ওঠে। 

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে আমরা আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এই কোমল কাদামাটি গুলোকে দিয়ে এমন একটি পাত্র তৈরী করছি যার মধ্যে সময়ের সাথে সাথে কোন পরিবর্তন নেই, কোন পরিবর্ধন নেই। সেই ইংরেজদের সময় থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে তৈরী করা হয়েছে, এখনো ঠিক সেভাবেই তা চলছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো আমরা পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করাটাকেই একটি ছাত্রের সর্বোচ্চ অর্জন হিসেবে বিবেচনা করি কিন্তু সে আদৌও ঐ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ও শিখতে পেরেছে কিনা, তার অর্জিত জ্ঞানকে সে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারবে কিনা, তার কর্মক্ষেত্রে সেই জ্ঞানকে পুঁজি করে সে সফলতা লাভ করতে পারবে কিনা এগুলো আমরা কখনো ভেবে দেখি না। আমাদের এই ধ্যান ধারণাকে পরিবর্তন করতে হবে। আমরা জানি বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হচ্ছে তরুণ সমাজ। এই বিশাল জনশক্তিকে যদি আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি তবে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে একটি উল্লেখ্যযোগ্য অবস্থানে পৌছে দিতে সক্ষম হবো কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সঠিক যত্ন, শিক্ষা ও দিক নির্দেশনা। এখনকার যুগের তরুন সমাজ ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত। তারা ছোটবেলা থেকে মোবাইল, কম্পিউটার ব্যবহার করে বড় হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে তারা এসব উপকরণ ব্যবহার করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গেম খেলার জন্য যার ফলে তাদের গেমের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি বৃদ্ধির ফলে বাহিরের বিশ্ব ও জীবন সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই তারা উদাসীন হিসেবে বড় হচ্ছে। 

এখন প্রযুক্তি নির্ভর এই যুগে আমরা চাইলেও আমাদের ছেলে মেয়েদের ছোটবেলা থেকে প্রযুক্তির বাহিরে রাখতে পারবো না। কিন্তু আমরা চাইলেই তাদেরকে এই প্রযুক্তিকে নানান রকম Creative ও Innovative কাজে লাগানোর ব্যাপারে শেখাতে পারি। আমরা যদি তাদেরকে ছোটবেলা থেকে স্মার্টফোন, কম্পিউটার থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের পড়াশোনাতে Creativityকে প্রাধান্য দেই, Innovationকে প্রাধান্য দেই, Out of The Box চিন্তা করে নতুন কিছু গড়ার ও করার জন্য প্রাধান্য দেই পাশাপাশি শিক্ষকেরাও যদি শুধুমাত্র তাদের পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের মেধাগুলোকে খুঁজে বের করে সঠিক কাজে লাগানোর দিক নির্দেশনা দেয় তবে অনায়াসেই আমরা ভবিষ্যতে একটি মেধাবী ও সফল প্রজন্ম তৈরী করতে সক্ষম হবো। সহজ কথায় বলতে গেলে, আমরা যদি শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকে Creativity ও Innovation নিয়ে কাজ করা সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করে দেই, তবে তারা ছোটবেলা থেকেই এই বিষয়গুলোকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারবে এবং তারা যখন বড় হবে তখন তারা তাদের এই Creativity ও Innovationকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই তাদের কর্মক্ষেত্রে একটি সফল অবস্থান তৈরী করতে সক্ষম হবে।

এখন সময় এসেছে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর। আমরা প্রায়ই দেখে থাকি আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলে মেয়েরা তাদের ছাত্রজীবনে যে বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে কর্মজীবনে গিয়ে দেখা যায় যে সে সম্পূর্ণ বিপরীত একটি সেক্টরে কাজ করছে। যেমন, যে ছেলেটা কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করছে, দেখা যায় যে পড়াশোনা শেষে সে BCS দিচ্ছে বা ব্যাংকে চাকরী করছে। এর কারণ অনুসন্ধান করলে আমরা পাবো যে আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলে মেয়েই পড়াশোনার বিষয় বেছে নেয় তাদের বাবা-মায়ের ইচ্ছায় কিংবা আর সকলের দেখাদেখি স্রোতের সাথে তাল মেলানোর জন্য। কিন্তু একটি ছেলে বা মেয়ের যে বিষয়ে মেধা, আগ্রহ ও দক্ষতা আছে, সেই বিষয়টি নিয়ে সে পড়াশোনা করার সুযোগ পায় না যার ফলে তার ছাত্রজীবনে পড়াশোনাটাও ঠিক মত হয় না আবার কর্মক্ষেত্রে গিয়ে সে কোন চাকরী করবে বা কিভাবে চাকরী পাবে এ ব্যাপারেও দিশা হারিয়ে ফেলে। এ ক্ষেত্রে সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে বাবা-মা ও শিক্ষকের। বাবা-মাকে বুঝতে হবে যে তার ছেলে বা মেয়ের কোন বিষয় সম্পর্কে আগ্রহ আছে। তাকে ছোটবেলা থেকেই সেই বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষককে বুঝতে হবে তার ক্লাসের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর মেধা সম্পর্কে। একজন যোগ্য শিক্ষক চাইলে খুব সহজেই বুঝতে পারে যে তার কোন ছাত্র উদ্যোক্তা হবার মন মানসিকতার ও কোন ছাত্র চাকরি করার প্রতি আগ্রহী। তাদেরকে সেই অনুযায়ী দিক নির্দেশনা দিতে হবে যেন তারা তাদের জীবনের সঠিক লক্ষ্যটি খুঁজে পায়। কখনোই কাউকে স্কুল কলেজের নির্দিষ্ট সিলেবাসের মধ্যে বেধে রাখা যাবে না। তাদেরকে সিলেবাসের বাহিরে গোটা পৃথিবী থেকে কিভাবে জ্ঞান আহরণ করা যায় সে সম্পর্কে শেখাতে হবে।

আমরা যদি পৃথিবীর সফল মনীষীদের জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি তবে আমরা দেখবো কেউই কখনো তাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট সিলেবাসের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। তারা নিজ উদ্যোগে নানান রকম মাধ্যম থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করে নিয়েছে। অনেকে তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার সুযোগই পায়নি কিন্তু তবুও কোন বাধা বিপত্তি তাদেরকে আটকে রাখতে পারেনি। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও তার রেজাল্ট দিয়ে কখনো কাউকে মুল্যায়ন করা যায় না। এ ব্যাপারে বিল গেটস এর একটি উক্তি খুবই বিখ্যাত, “I failed in some subject in exam but my friend passed in all. Now he is an engineer in Microsoft and I am the owner of Microsoft.”। এই কারণে প্রতিটি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত তাদের পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাসকে যুগোপযোগী করে তৈরী করার পাশাপাশি শিক্ষকদেরও উচিত গৎবাধা নিয়মের বাহিরে এসে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভবিষ্যতের Job Market এর জন্য প্রস্তুত করা। 

আমাদের দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর শত শত ছাত্র-ছাত্রী Graduation শেষ করে বের হচ্ছে কিন্তু তাদের মধ্যে কত জন্য নিজেকে সফল ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে ? তার পরিসংখ্যান কি সেই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ? এখন সময় এসেছে এই পরিসংখ্যানটি তৈরী করার। কারণ সকল স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পরিবেশ, মান, সিলেবাস ও শিক্ষকের যোগ্যতা এক নয়। যে সকল প্রতিষ্ঠানের Alumni দেশে ও বিদেশে সম্মানজনক অবস্থানে আছে, সেই সকল প্রতিষ্ঠানকে মডেল হিসেবে তাদের Education Strategy গুলোকে অনুসরণ করা উচিত। 

অবশেষে, ইহা বলাই বাহুল্য যে আগামী প্রজন্মকে ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে নিজেদেরকে সফল অবস্থানে নিয়ে যেতে রীতিমত সংগ্রাম করতে হবে কারণ বর্তমানে Covid-19 এসে গোটা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা ও চাকরির বাজারকে তুমুলভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন চাকরির প্রতিযোগীতায় শুধু মাত্র তারাই টিকে থাকতে পারবে যারা মূলত Certificate এর দমে নয় বরং কর্মমুখী জ্ঞান, মেধা ও দক্ষতার জোরে লড়াই করতে পারবে। যাদের এই যোগ্যতা গুলো থাকবে তারা পৌছে যাবে সফলতার শীর্ষে আর যারা শুধু মাত্র প্রাতিষ্ঠানিক রেজাল্টকে পুঁজি করে এই প্রতিযোগীতায় নামবে তারা সর্বদা পিছেই পড়ে থাকবে, কখনো সামনে আগাতে পারবে না। তাই আজকের এই কঠিন সময়ে এসে দেশের সকল বাবা-মা ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিকট একটিই প্রশ্ন, আপনারা আপনাদের আগামী প্রজন্মকে কি রকম ভবিষ্যত উপহার দিতে চান? সিদ্ধান্তটা আপনাদেরকেই নিতে হবে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *