‘Every failure is an opportunity’ – Md. Sabur Khan (Prothom Alo Interview)
# যত দূর জানি, আপনি পাইলট হতে চেয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে পড়েছেন। জীবনে নিশ্চয়ই এমন একটা মুহূর্ত এসেছে, যেটা আপনার ক্যারিয়ারের গতিপথ ঠিক করে দিয়েছে।
- এটা ঠিক যে স্কুল-কলেজে আমার পাইলট হওয়ার ইচ্ছা ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেনাবাহিনীর লং কোর্সে টিকেও গিয়েছিলাম। আমি ও আমার এক বন্ধুর সকাল ১০টায় রিপোর্টিং করার কথা। অর্থাৎ সকাল ৮টায় জাহাঙ্গীরনগর থেকে রওনা হতে হবে। সকালে বন্ধু যখন আমার রুমের দরজায় টোকা দিল, কেন যেন বলে বসলাম, আমি যাব না। মনে হচ্ছিল, আর্মিতে চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনটা মিস করব। সবাই খুব অবাক হয়েছিল। মা-বাবা অখুশি হয়েছিলেন। সেদিন যদি আর্মিতে যেতাম, হয়তো জীবনটা অন্য রকম হতো। কিন্তু এই সুযোগটা হারানোর কারণে আমার জেদ চেপে গিয়েছিল। এরপর আরও নানা কিছু করেছি। বিদেশে যাব ভেবে টোয়েফল দিয়েছি। স্নাতক শেষ হওয়ার পর দেখি বন্ধুরা সবাই বিসিএস দেয়, আমিও দিলাম। টিকে গেলাম। আমার পোস্টিং হয়েছিল ডাক বিভাগে। পররাষ্ট্র ক্যাডার পেলে হয়তো সরকারি চাকরিতেই যেতাম। আবার ব্যাংকে চাকরি পেয়েছি। কিন্তু ব্যবসা করার ইচ্ছে সব সময় ছিল, তাই মাস্টার্সের রেজাল্ট হওয়ার আগেই আমি ব্যবসা শুরু করেছিলাম। আমি মনে করি প্রতিটা ব্যর্থতাই একেকটা শিক্ষা। এই যে পররাষ্ট্র ক্যাডারে হলো না, এই ব্যর্থতা আমাকে আরও ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
# এখন যেমন সবকিছুই কম্পিউটারনির্ভর, প্রযুক্তিনির্ভর। নব্বইয়ের দশকে তো এমনটা ছিল না। কম্পিউটারের ব্যবসা কেন শুরু করলেন?
- আমার সব সময় একটা মনোভাব ছিল, আমি সেই ব্যবসাই করব, যেটা সম্পর্কে আমি ভালো জানি। সে সময় কম্পিউটার হয়তো এত পরিচিত ছিল না, কিন্তু যে অল্প কয়েকটা প্রোগ্রাম ছিল, সেগুলোই খুব ভালো জানতাম। কম্পিউটার নিয়ে যেহেতু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, ভাবলাম এই খাতেই ব্যবসা করি। সে সময় কম্পিউটার সায়েন্স নামে কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু আমাদের সময়ই প্রথম কম্পিউটার সায়েন্স নামে ১০০ নম্বরের একটা কোর্স চালু হলো। আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। কারণ পরিসংখ্যানের কিছু বিষয় মজা লাগত না, কিন্তু কম্পিউটার সায়েন্স খুব ভালো লাগত।
# ছাত্রজীবন থেকেই বোধ হয় ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা আপনার মধ্যে ছিল। একজন উদ্যোক্তা হতে হলে যেই বৈশিষ্ট্যটা খুব প্রয়োজন।
- হ্যাঁ। আমি কখনোই বেকার থাকতে পছন্দ করতাম না। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দীর্ঘ দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকত। এলাকায় গিয়ে তরুণদের ডেকে তখন উন্নয়নের অগ্রদূত নামে একটা সামাজিক সংগঠনের কাজ করতাম। স্কুলে পড়ার সময় খেলাঘর আসর করেছি, স্কাউটিং করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে রোটার্যাক্ট ক্লাবে খুব সক্রিয় ছিলাম। সব সময় আগ্রহ ছিল নতুন কিছু করার। পারি বা না পারি, কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক, গান, সবকিছুতে নাম লেখাতাম। কখনো কখনো পুরস্কারও পেতাম। এখন বুঝি, এই আগ্রহই পরে কর্মজীবনে কাজে এসেছে।
# ২৪ জানুয়ারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ১৭ বছর পূর্ণ হলো। ২০০২ সালে যখন শুরু করেছিলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপনার ভাবনা কী ছিল?
- আমাদের খুব সৌভাগ্য, শুরুতেই উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের মতো একজন মানুষকে পেয়েছিলাম। তিনি এত দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব নিয়েছিলেন যে সত্যি বলতে, ২০০৭ সাল পর্যন্ত আমি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে খুব একটা ভাবিনি। ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা মূল্যায়ন করল। দেখলাম সেরা ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমাদের অবস্থান ৬ নম্বরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স তখন মাত্র ৪-৫ বছর, অনেক সময় শিক্ষকদের বেতন ঠিকমতো দিতে পারি না, নানা সমস্যা। আমি খুব অবাক হলাম, এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কীভাবে আমরা এত ভালো করলাম। তখন বুঝলাম, এটা আসলে অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের কঠিন নিয়মকানুন ও স্বচ্ছতার ফল। এই ঘটনাটা আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করল। তখন মনে হলো, আমিনুল ইসলাম স্যার যদি বিশ্ববিদ্যালয়টাকে এত দূর নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে আমি কেন আমার অভিজ্ঞতাটাও তাঁর সঙ্গে যোগ করি না? বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দিতে শুরু করলাম। ঠিক করলাম, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আমরা একটা করে ল্যাপটপ দেব, বিনা মূল্যে। তখন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমরা প্রায় ৩৪ হাজার ছাত্রছাত্রীকে ল্যাপটপ দিয়েছি।
# ল্যাপটপ দেওয়ার কথা ভাবলেন কেন?
- আমার ভাবনা ছিল, শিক্ষার্থীরা যদি ল্যাপটপ পায়, তারা কর্মজীবনে ভালো করবে। তাদের একটা বিরাট অংশ এটাকে কাজে লাগাবে। হয়েছেও তাই। আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিংসহ তথ্যপ্রযুক্তির সব খাতে দেখবেন আমাদের ছেলেমেয়েরা ভালো করছে। কয়েক দিন আগে একটা ছেলে এসে বলল, স্যার, আমি নারায়ণগঞ্জে একটা ব্যবসা করছি। আপনাকে একটা প্রেজেন্টেশন দেখাতে চাই। সে যখন প্রেজেন্টেশন দিতে শুরু করল, দেখলাম সে ড্যাফোডিলের দেওয়া ল্যাপটপ নিয়ে এসেছে। সে যখন বলল, স্যার, এই ল্যাপটপ দিয়েই তো আমি জ্যামে বসে পরিকল্পনা করেছি, ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছি; আমার মন ভরে গেল।
# উদ্যোক্তা তৈরির জন্য আপনি অনেক দিন ধরেই কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ নামে একটা বিভাগ আছে। শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আরও নানা রকম কার্যক্রম আছে ড্যাফোডিলের।
- প্রতি সপ্তাহে আমরা ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটা স্টার্টআপ মার্কেটের সুযোগ করে দিই। এই মার্কেটে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন পণ্য সাজিয়ে বিক্রি করে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্তোরাঁ চালানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের খাবার কিংবা টি–শার্ট সরবরাহ…সবকিছুই করে শিক্ষার্থীরা। একটা দল পাস করে বের হয়ে যাচ্ছে, নিজের ব্যবসা চালু করছে। আবার নতুন একটা ব্যাচ এসে হাল ধরছে। এ ছাড়া আমরা ক্যাম্পাসে প্রচুর প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। হাল্ট প্রাইজ, গেট ইন দ্য রিং, আর ইউ নেক্সট স্টার্টআপ, স্টার্টআপ আইডিয়া ফর ফান্ড…এই সব প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যই হলো শিক্ষার্থীকে ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করা, চর্চা করার সুযোগ করে দেওয়া। সম্প্রতি একটা তহবিল চালু করেছি। আমি ছাত্রছাত্রীদের কিছু ক্লাস নিই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী তার জন্য আমাকে বেতন দেওয়া হয়। আমি বললাম, আমি বেতন নিলে সেটা তো ভালো দেখা যায় না। এই টাকাটা দিয়ে বরং একটা তহবিল গঠন করা হোক। উদ্যোক্তা উন্নয়ন তহবিল। কোনো শিক্ষার্থী যদি ব্যবসা করতে চায়, তার যদি তহবিলের দরকার হয়, সে বিনা সুদে এই তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবে।
# তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য যদি সংক্ষেপে ৩টি পরামর্শ দিতে বলি…
- প্রথম পরামর্শ হলো, শুরু করো। দ্বিতীয় পরামর্শ, ফান্ড নিয়ে ভেবো না। শুরু করতে পারলে ফান্ডের ব্যবস্থা হবে। তৃতীয় পরামর্শ হলো, সব লিখে রাখো। আমি অনেক বড় ব্যবসায়ীকে দেখেছি, যদি বলি আপনার ব্যবসার পরিকল্পনা আমাকে পাঠান, আমি একটু বিশ্লেষণ করে দেখি। দিতে পারে না। এটা খুব দুঃখজনক। মাথায় রাখলে হবে না। নোট রাখতে হবে। তাহলে পরিকল্পনাটা গোছানো হয়, ভুলগুলো জানা যায়।